ঢাকা: পকেটে স্পাই মোবাইল। বাংলাদেশে বসে কথা বলছেন আর তা রেকর্ড হয়ে ভিডিও আকারে চলে যাচ্ছে পাকিস্তানের গোয়েন্দা সংস্থার এক কর্মকর্তার কাছে। সহযোগিতায় রয়েছেন বাংলাদেশে নিযুক্ত পাক হাইকমিশনের এক নারী কর্মকর্তা। চলছে জেএমবির জঙ্গি কার্যক্রম। গোয়েন্দা পুলিশের হাতে আটক ইদ্রিস শেখের জঙ্গি কার্যক্রম পরিচালনা সম্পর্কে এমন ভয়াবহ সব তথ্য দিয়েছেন মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের যুগ্ম কমিশনার মনিরুল ইসলাম। সোমবার সকালে ডিএমপির মিডিয়া সেন্টারে আটক চার জেএমবি সদস্য সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য তুলে ধরেন এই গোয়েন্দা কর্মকর্তা। এর আগে নিষিদ্ধ জঙ্গি সংগঠন জামায়াতুল মুজাহিদিন বাংলাদেশের (জেএমবি) সন্দেহভাজন চার সদস্যকে আটক করেছে বলে গণমাধ্যমকে জানান মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের উপ-কমিশনার (মিডিয়া) মুনতাসিরুল ইসলাম। তিনি বলেন, গত রোববার রাতে ওই অভিযানে বেশ কিছু বই, বিদেশি মুদ্রা ও পাসপোর্ট জব্দ করা হয়েছে। তবে জঙ্গিদের নাম প্রকাশ করেননি তিনি। এ সময় সংবাদ সম্মেলন করে এ বিষয়ে বিস্তারিত তথ্য প্রকাশ করা হবে বলে তিনি জানান। গতকাল সোমবার সকাল সাড়ে ১১টায় মিডিয়া সেন্টারে মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের যুগ্ম কমিশনার মনিরুল ইসলাম জানান, আটক চার জঙ্গিরা হলেন মো. ইদ্রিস শেখ, মো. মকবুল শরিফ, মো. ছালাম ও মো. মুস্তফা জামান। তাদের কাছ থেকে ২৬টি জিহাদি বই, ২টা পাকিস্তানি ও ১টি বাংলাদেশি পাসপোর্ট, ৫টি মোবাইল, চার হাজার পাকিস্তানি রুপি, দেড় হাজার ভারতীয় রুপি, বাহরাইনের এক হাজার ৩০০ ডলার, জর্ডানের এক হাজার ৬০০ ডলার উদ্ধার করা হয়েছে। মনিরুল ইসলাম বলেন, ইদ্রিসের কাছ থেকে স্পাই মোবাইল উদ্ধার করা হয়েছে। স্পাই মোবাইলটি পাকিস্তানি গোয়েন্দা সংস্থার এক কর্মকর্তার। বাংলাদেশ থেকে তিনি যা বলতেন সে কথাগুলো রেকর্ড আকারে ভিডিওসহ পাকিস্তানের ওই গোয়েন্দা কর্মকর্তার কাছে চলে যেত। ইদ্রিস শেখের সঙ্গে বাংলাদেশ নিযুক্ত পাকিস্তানি হাইকমিশনের এক নারী কর্মকর্তার সাথে ঘনিষ্ট যোগাযোগ আছে বলে জানান এই গোয়েন্দা কর্মকর্তা। তিনি জানান, ১৯৮৫ সালে দালালের মাধ্যমে ভারতে যায় ইদ্রিস। পরে ভারত থেকে পাকিস্তানে ঢোকেন তিনি। ১৯৯০ সালে পাকিস্তানের এক নাগরিককে ইদ্রিস বিয়ে করেন। পরে ইদ্রিস পাকিস্তানে শুধু রাজনৈতিক কর্মকা-ে জড়িতই ছিলেন না, একবার জাতীয় নির্বাচনে অংশগ্রহণও করেন। মনিরুল ইসলাম বলেন, ২০০২ সালে ইদ্রিস পাকিস্তানের রাজনৈতিক দল পাক মুসলিম অ্যালায়েন্স-এর পক্ষে জাতীয় নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে পরাজিত হন। এরপর ২০০৭ সালে তিনি আবার বাংলাদেশে আসেন এবং জেএমবির সক্রিয় সদস্য হিসেবে কার্যক্রম শুরু করেন। বাংলাদেশে আসার পর বাগেরহাটের একটি ঠিকানা ব্যবহার করে ইদ্রিস শেখ পাসপোর্ট বানান। গত দুই বছরে তিনি ৪৮ বার পাকিস্তানে প্রবেশ করেছেন। অর্থাৎ মাসে দুবার করে ইদ্রিস পাকিস্তানে যাতায়াত করেছেন। ২০০৪ সালে পাকিস্তানি পাসপোর্টসহ একবার র্যাবের হাতে আটক হন ইদ্রিস। পরে তাকে ছেড়ে দেয়া হয়। শুধু ইদ্রিস নয়, আটক জেএমবি সদস্য মকবুলেরও রয়েছে পাকিস্তান কানেকশন। ১৯৮৫ সালে দালালের হাত ধরে ভারত হয়ে পাকিস্তানে যান মকবুল। কাপড় ব্যবসায়ী হিসেবে তিনি পাকিস্তানে নিয়মিত যাতায়াত করেন। এর আড়ালে তিনি জেএমবির কার্যক্রম পরিচালনা করেন। অর্থও যোগান দেন। মনিরুল ইসলাম বলেন, ১৯৮৯ সালে মকবুল ভারত হয়ে পাকিস্তানে যান। তিনি ভুয়া পাকিস্তানি পাসপোর্ট ব্যবহার করেন। পাকিস্তানে অবস্থানরত আবদুল কুদ্দুস নামে এক রোহিঙ্গা নাগরিককের সঙ্গে তার ঘনিষ্ট যোগাযোগ আছে। শুধু তাই-ই নয়, বাংলাদেশে রোহিঙ্গাদের ভুয়া পাসপোর্ট তৈরিতে সহযোগিতা করে আটক জেএমবি সদস্য মকবুল। এভাবে তিনি অনেককে পাকিস্তান, কানাডা ও অস্ট্রেলিয়া পাঠিয়েছেন। পাকিস্তান থেকে আবদুল কুদ্দুসের পাঠানো অর্থ দিয়ে মকবুল জেএমবি কার্যক্রম পরিচালনা করেন। তবে ইদ্রিস শেখ ও মকবুল শরিফ বাংলাদেশি না পাকিস্তানি নাগরিক তা নিয়ে দ্বিধায় আছেন গোয়েন্দারা। কারণ এদের কাছে দুই দেশেরই নানা ডকুমেন্ট পাওয়া গেছে। আটক অপর দুই জেএমবি সদস্য ছালাম ও মুস্তফা জামান সম্পর্কে আংশিক তথ্য জানান যুগ্ম কমিশনার মনিরুল ইসলাম। তিনি জানান, ঢাকার এক বিহারী ক্যাম্পে থাকেন ছালাম। তারও পাকিস্তানে নিয়মিত যাতায়াত আছে। মোস্তফা বাংলাদেশি। তিনি পাকিস্তান এয়ারলাইন্সের অ্যাসিস্ট্যান্ট ট্রাফিক ইন্সপেক্টর। গত রোববার বিকাল ৪টা থেকে রাত ১০টা পর্যন্ত রাজধানীর এয়ারপোর্ট ও খিলগাঁও থানা এলাকায় অভিযান চালিয়ে চার এই চার জেএমবি সদস্যকে আটক করা হয়। মনিরুল ইসলাম জানান, চারজনই ভারতীয় জাল মুদ্রার ব্যবসা করে। জালমুদ্রাগুলো করাচি থেকে এনে ঢাকা হয়ে ভারতে পাচার করে তারা। এর আগে ডিবি পুলিশ যে ৭ পাকিস্তানি নাগরিককে জেএমবি সন্দেহে গ্রেপ্তার করেছিল, তাদের সঙ্গে এই চার জনের ঘনিষ্ট যোগাযোগ আছে। এর আগে যেসব জেএমবি সদস্য আটক করা হয়েছে তাদের কারো কারো সঙ্গে একটি বিদেশি গোয়েন্দা সংস্থার কর্মকর্তাদের ঘনিষ্ট যোগাযোগের দালিলিক প্রমাণ আছে, বলেন মনিরুল। জেএমবি এখন তিন গ্রুপে বিভক্ত। গ্রেপ্তারকৃত চারজন বর্তমানে কারাগারে আটক সাইদুর রহমান গ্রুপের সক্রিয় সদস্য। এরা জেএমবিকে সক্রিয় করে নাশকতামূলক কর্মকা- চালিয়ে সরকারকে বিব্রত করতে চায়। মনিরুল বলেন, এখন পর্যন্ত বাংলাদেশে আইএসের সাংগঠনিক ভিত্তির দালিলিক প্রমাণ পাইনি। তবে বর্তমানে যে কয়টি জঙ্গি সংগঠন বাংলাদেশে সক্রিয় তাদের মধ্যে জেএমবি, আনসারুল্লাহ বাংলাটিম এবং হরকাতুল জিহাদ অন্যতম। তিনি জানান, আনসারুল্লাহ বাংলাটিমের অধিকাংশ গা ঢাকা দিলেও একেবারে নিষ্ক্রিয় নয়। হরকাতুল জিহাদ পুনরুজ্জীবিত হওয়ার চেষ্টা চালাচ্ছে। জেএমবি তিন ধারায় বিভক্ত হয়ে কাজ করছে। জঙ্গি দমনে গোয়েন্দা কর্মকর্তারা জিরো টলারেন্স নিয়ে কাজ করছেন বলেও জানান ডিএমপির এই গোয়েন্দা কর্মকর্তা। তবে আশঙ্কার কথাও জানান তিনি। বলেন, সারাদেশে এখন উগ্র জঙ্গিবাদ ছড়িয়ে পড়েছে। তরুণরা ইন্টারনেটের মাধ্যমে এদের কার্যক্রম সম্পর্কে পড়াশোনা করে বিভ্রান্ত হচ্ছে। পুলিশের একার পক্ষে জঙ্গিবাদ দমন করা সম্ভব নয়। আর তা পৃথিবীর কোনো পুলিশের পক্ষেই সম্ভব নয়। এ জন্য সমাজকেও এগিয়ে আসতে হবে। জঙ্গিবাদ দমনে অভিভাবক, শিক্ষক ও মিডিয়ার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকার কথা উল্লেখ করে মনিরুল ইসলাম বলেন, আশা করি সব পক্ষ সহযোগিতা করবে।
বিদেশ বাংলা